বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় একটি অ্যাপ উইচ্যাট। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং অ্যাপ হিসেবে ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইন্সটাগ্রামের পরেই উইচ্যাটের অবস্থান। তবে উইচ্যাট শুধুমাত্র একটি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপই নয়। অনলাইন নির্ভর বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় এই অ্যাপ দিয়ে।
উইচ্যাট এর মত অ্যাপকে সাধারণত ‘সুপার অ্যাপ’ বলা হয়। মূলত যেই অ্যাপ দিয়ে একাধিক অ্যাপের কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়, সেই অ্যাপ এর অন্য নাম সুপার অ্যাপ। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে সফল সুপার অ্যাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয় উইচ্যাটকে। আজকের এই ব্লগে আমরা এই অ্যাপ সম্পর্কে জানবো।
উইচ্যাট কি?
ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা, বিমান বা গণপরিবহনের টিকিট কাটা, ট্যাক্সি ক্যাব ডাকা, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা, টাকা ধার করা, অনলাইন শপিং করা, ভিসার জন্য আবেদন, কেনাকাটার বিল পরিশোধ করা কিংবা ভিক্ষুককে অর্থ সাহায্য প্রদান থেকে শুরু করে থানায় জিডি বা মামলা করা পর্যন্ত দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব ধরনের কাজ করা যায় উইচ্যাট দিয়ে।
সম্প্রতি করোনা ভাইরাস মহামারী চলাকালীন যখন চীনে কঠোর লকডাউন চলছিল, তখন দেশটির নাগরিকদের বাইরে চলাচলের জন্যে বিশেষ ‘হেলথ কোড’ এর প্রয়োজন হত। আর এই ‘হেলথ কোড’ যাচাই করা হত উইচ্যাট ব্যবহার করেই।
১০০টিরও বেশি দেশে বর্তমানে উইচ্যাট ব্যবহার করা যায়। তবে সাধারণত চীনের ব্যবহারকারীরাই উইচ্যাট এর সকল সুবিধা ভোগ করতে পারেন।
আরও পড়ুনঃ এক অ্যাপেই নেওয়া যাবে বিসিএস, চাকরি ও এডমিশন প্রস্তুতি!
ইংরেজিতে অ্যাপটি উইচ্যাট নামে পরিচিতি পেলেও চীনের নাগরিকদের কাছে এটি ‘ওয়েইসিন’ (Weixin) নামে পরিচিত। চীনা ভাষায় ‘ওয়েই’ শব্দটির অর্থ ছোট বা ক্ষুদ্র এবং ‘সিন’ শব্দটির অর্থ বার্তা বা চিঠি। ইংরেজিতে ‘ওয়েইসিন’ শব্দটির অর্থ ‘মাইক্রো মেসেজ’, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ক্ষুদ্র বার্তা’। ২০২৩ সালে এসে প্রতি মাসে ১.৬৭১ বিলিয়ন মানুষ সক্রিয়ভাবে উইচ্যাট ব্যবহার করেন। তবে উইচ্যাট-এ এখনও পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন করেছেন ২ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ।
চীনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৮২ শতাংশ মানুষ প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহার করেন উইচ্যাট। এবং দেশটিতে উইচ্যাট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮২৭.২ মিলিয়ন, যা চীনের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৯ শতাংশ। অন্য আরেক জরিপ অনুসারে, চীনের ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ ব্যবহার করেন এই সুপার অ্যাপ।
উইচ্যাট: শুরু থেকে বর্তমান
উইচ্যাট নির্মাণ করেছে চীনের প্রতিষ্ঠান ‘টেনসেন্ট’। ২০১০ সালে অ্যাপটির নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয় ‘টেনসেন্ট গুয়াংজু রিসার্চ অ্যান্ড প্রজেক্ট সেন্টার’ নামের একটি গবেষণা কেন্দ্রে। চীনের কম্পিউটার প্রোগ্রামার এবং প্রযুক্তি ব্যবসায়ী অ্যালেন ঝাং এর নেতৃত্বে একদল প্রোগ্রামার অ্যাপটির প্রথম সংস্করণ তৈরি করেন।
নির্মাণের পরে এই অ্যাপের নাম দেয়া হয় ‘ওয়েইসিন’ (Weixin)। নামটি নির্ধারণ করেন টেনসেন্ট এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও মা হুয়াতেং, যিনি ‘পনি মা’ নামেও পরিচিত। চীনের প্রযুক্তি বাজারে জ্যাক মা এর আলিবাবা’র সঙ্গে টেক্কা দিতে সক্ষম একমাত্র প্রতিষ্ঠান হল পনি মা এর টেনসেন্ট। তবে জ্যাক মা এর তুলনায় মিডিয়ার সামনে খুবই কম আসেন পনি মা। এতে তিনি বহির্বিশ্বে তুলনামূলক কম পরিচিত।
যাহোক, ‘ওয়েইসিন’ মুক্তি পায় ২০১১ সালে। তবে শুরুর দিকে খুব বেশি মানুষ ব্যবহার করেনি এই অ্যাপ। চীনে ওয়েইসিন জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে অ্যাপটির ‘ওয়াকি-টকি’ নামের একটি ভয়েস মেসেজিং ফিচারের মধ্যে দিয়ে। এই জনপ্রিয়তার মধ্য দিয়েই ২০১২ সালের মধ্যে ‘ওয়েইসিন’ এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। ফলে সে বছরই (২০১২) আন্তর্জাতিক বাজারে এই অ্যাপের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে চীনের বাইরের ব্যবহারকারীদের জন্য অ্যাপটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘উইচ্যাট’।
২০১৩ সালে এই অ্যাপে অর্থ লেনদেনের ফিচার ‘উইচ্যাট পে’ যুক্ত করা হয়। ফলে আরেক দফায় জনপ্রিয়তা অর্জন করে অ্যাপটি। এবং এক বছরের মধ্যেই নতুন করে ৪০০ মিলিয়ন মানুষ চালানো শুরু করেন উইচ্যাট। ২০১৯ সালের মধ্যে উইচ্যাট এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ বিলিয়নে পৌঁছায়। বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ হল উইচ্যাট, যেখানে প্রতিদিন ৪৫ বিলিয়ন মেসেজ আদানপ্রদান হয়।
যে কারণে উইচ্যাট কে বলা হয় ‘সুপার অ্যাপ’
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, অ্যাপল পে, উবার, অ্যামাজন বা টিন্ডার এর মত জনপ্রিয় সব অ্যাপ বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহার করা হয়। তবে উইচ্যাট থাকলে এসব অ্যাপের কাজ একটা অ্যাপ দিয়েই করা যায়। এ কারণেই উইচ্যাট এর মত অ্যাপকে বলা হয় ‘সুপার অ্যাপ’ বা ‘অ্যাপ ফর এভ্রিথিং’।
বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহারের তুলনায় এক অ্যাপ দিয়েই যদি সব ধরনের কাজ পরিচালনা করার ধারণা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সুপার অ্যাপ ব্যবহার করলে একাধিক অ্যাপ ইন্সটল করা বা সেসব অ্যাপের পাসওয়ার্ড মনে রাখার মত বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকা যায়। আর সুপার অ্যাপের এই ধারণা জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে সবচেয় বড় অবদান রেখেছে উইচ্যাট।
উইচ্যাট মিনি প্রোগ্রাম
মূলত উইচ্যাট এর ‘মিনি প্রোগ্রাম’ ফিচারের মধ্য দিয়েই এটি সুপার অ্যাপ হয়ে উঠেছে। সহজ কথায় বললে, উইচ্যাট অ্যাপের মধ্যে থাকা অন্যান্য অ্যাপকে ‘মিনি প্রোগ্রাম’ বলা হয়। ইউজাররা তাদের প্রয়োজন অনুসারে উইচ্যাট থেকে এসব মিনি প্রোগ্রাম ব্যবহার করতে পারেন। অ্যান্ড্রয়েড, উইন্ডোজ বা আইওএস এর মত যেকোনো অপারেটিং সিস্টেম এর জন্য যেভাবে বিভিন্ন নির্মাতারা অ্যাপ তৈরি করেন, ঠিক সেভাবেই উইচ্যাটে সংযুক্ত করার জন্য নির্মাতারা তৈরি করেন ‘মিনি প্রোগ্রাম’। এ ধরনের একেকটা মিনি প্রোগ্রামের আকারও খুব ছোট হয়, ১০ মেগাবাইটের মত।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লেখা অনুবাদ করার জন্যে উইচ্যাট-এ রয়েছে বিশেষ মিনি প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রাম এর সাহায্যে হাতে লেখা কাগজ থেকে স্ক্যানের মাধ্যমে তা অনুবাদ করে সেটার অনলাইন কপি তৈরি করা যায়।
আবার জরিপ পরিচালনা করার জন্যে উইচ্যাট-এ আছে ‘টেনসেন্ট সার্ভে’ নামের আরেকটি মিনি প্রোগ্রাম। চীনের বিভিন্ন শেয়ার বাজারে লেনদেন করা বা শেয়ারের মূল্যের ব্যাপারে সর্বশেষ খবরাখবর জানার জন্যেও রয়েছে বিশেষ মিনি প্রোগ্রাম।
আবার টেনসেন্ট এর কাছে চীনের বিভিন্ন প্রান্তে জনগণের জন্যে উন্মুক্ত পাবলিক ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের পাসওয়ার্ড রয়েছে। ফলে উইচ্যাট ইউজাররা পাসওয়ার্ডের ঝামেলা ছাড়াই এসব পাবলিক ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। আর এ কাজের জন্যে উইচ্যাটে রয়েছে বিশেষ আরেকটি মিনি প্রোগ্রাম।
এর বাইরে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ দেখার জন্যে একাধিক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, সংবাদ জানার জন্য নিউজ পোর্টাল, গেম খেলার প্ল্যাটফর্ম, টাইম ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ, শিক্ষার্থীদের জন্য লার্নিং অ্যাপ সহ নানান কাজের জন্য উইচ্যাটে মিনি প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত উইচ্যাট এর জন্য ৪ মিলিয়নেরও বেশি মিনি প্রোগ্রাম নির্মাণ করা হয়েছে। চীনা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ম্যাকডোনাল্ড’স এবং কেএফসি’র মত বিখ্যাত ফাস্ট ফুড চেইন এবং গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘ফোক্সওয়াগেন’ এর মিনি প্রোগ্রাম রয়েছে উইচ্যাটে।
এসব মিনি প্রোগ্রাম ছাড়াও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উইচ্যাটের মূল ফিচার হিসেবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্যান্য অনেক সুবিধা।
যেমন ২০১৬ সালে অ্যাপটিতে ‘উইচ্যাট আউট’ নামের একটি আইপি কলিং সার্ভিস যুক্ত করা হয়। উইচ্যাটের এই সার্ভিস দিয়ে সারা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মোবাইল ফোন এবং ল্যান্ডলাইনে ফোনকল করা যায়। আবার ২০১৭ সালে উইচ্যাট অ্যাপে সার্চ করার ফিচার যুক্ত হওয়ার পরে অ্যাপটি চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন ‘বাইদু’র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়।
উইচ্যাটের ইন্টারফেস
উইচ্যাটে এতসব সুবিধা থাকলেও অ্যাপটির ইন্টারফেস দেখতে খুবই সাধারণ। অনেকটা হোয়াটসঅ্যাপের মত দেখতে এই অ্যাপের বিভিন্ন ফিচার ব্যবহার করার সময় এর ইন্টারফেস একেবারেই পাল্টে যায়। যেমন অনলাইন শপিং করতে গেলে উইচ্যাট এর ইন্টারফেস দেখতে একরকম হবে। আবার খাবার অর্ডার করতে গেলে এর ইন্টারফেস হবে একেবারেই ভিন্ন।
তবে সময়ের সাথে সাথে উইচ্যাটে বিভিন্ন সুবিধা যুক্ত হওয়ায় উইচ্যাট অ্যাপ ইন্সটল করার সময় এর আকার থাকে অনেক বড়। অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে ব্যবহারের জন্যে নির্মিত উইচ্যাট এর সর্বশেষ সংস্করণ (জুলাই ২১, ২০২৩) এর আকার ২৪৯.২ মেগাবাইট। বর্তমানে অনেক কম্পিউটার সফটওয়্যারই এর চেয়ে ছোট। আবার ইন্সটলের পরও অ্যাপটির আকার বড় হতে থাকে। ইউজারদের দেয়া তথ্য অনুসারে, অনেকের ডিভাইসে উইচ্যাটের আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ গিগাবাইট বা তারও বেশি।
উইচ্যাট এর মূল ফিচার
উইচ্যাটে বিভিন্ন ধরনের মিনি প্রোগ্রাম থাকলেও এর বাইরে অ্যাপটিতে বেশ কিছু জনপ্রিয় ফিচার রয়েছে। এ ধরনের কিছু ফিচার হল:
- পাবলিক অ্যাকাউন্ট: উইচ্যাট এর ইউজাররা তাদের অ্যাকাউন্টকে পাবলিক অ্যাকাউন্ট হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন। ব্যক্তি ছাড়াও বিভিন্ন ব্র্যান্ড বা প্রতিষ্ঠানের পাবলিক অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
যেকোনো পাবলিক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা কন্টেন্টের ব্যাপারে সর্বশেষ তথ্য পেতে সেসব অ্যাকাউন্ট ফলো করতে হয়। মূলত এক ধরনের ব্লগ হিসেবে কাজ করে উইচ্যাট এর পাবলিক অ্যাকাউন্ট ফিচার। - মোমেন্টস: উইচ্যাট মোমেন্টস এর সাথে তুলনা করা যায় ফেসবুক এর নিউজফিড এর। মোমেন্টস-এ ইউজাররা তাদের বন্ধুদের নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা বা অন্য যেকোনো কিছু শেয়ার করে থাকেন।
ছবি, ভিডিও বা সংবাদ সহ কারো দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা থেকে শুরু করে শখ বা পছন্দের কোনো বিষয় মোমেন্টস-এ পোস্ট করা হয়। তবে উইচ্যাটে একজনের সাথে আরেকজন যুক্ত হতে হলে স্ক্যান করতে হয় কিউআর কোড। অর্থাৎ, যেকোনো দুজন ব্যক্তি সরাসরি একজন আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করার মাধ্যমেই অ্যাড হতে পারেন উইচ্যাটে। একটি উইচ্যাট অ্যাকাউন্ট দিয়ে সর্বোচ্চ ৫,০০০ জনের সঙ্গে যুক্ত থাকা যায়। - উইচ্যাট পে: চীনের যেকোনো জনবহুল শহরে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ সবজি বা তরকারি বিক্রেতাদের কাছেও মূল্য পরিশোধ করা যায় উইচ্যাট পে এর মাধ্যমে। স্ক্যান করার মাধ্যমে সহজেই মূল্য পরিশোধ বা অর্থ লেনদেন করা যায় এই ফিচার দিয়ে।
বলা হয়ে থাকে, উইচ্যাট পে থাকার কারণেই প্রচুর চীনা নাগরিক দীর্ঘদিন কাগজের টাকা হাতেই ধরেন না।
‘উইচ্যাট পে’ – মিনি প্রোগ্রাম নাকি সুপার অ্যাপ?
‘উইচ্যাট পে’ এর বিভিন্ন ফিচারের মধ্যে রয়েছে ইউজারের ব্যক্তিগত ‘ওয়ালেট’, যেখানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ডের মত উৎস থেকে টাকা লেনদেন করা যায়। এজন্য উইচ্যাটের সঙ্গে ইউজারকে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা কার্ড যুক্ত করতে হয়। ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করা, দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অর্থ দান করা, সিনেমাহলের টিকিট কেনা কিংবা ব্যবহৃত সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসপত্র কেনা থেকে শুরু করে ট্যাক্সিক্যাব ডাকার মত বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহার করা যায় উইচ্যাটের এই ফিচার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, জাপান, ইতালি, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কানাডা সহ বর্তমানে বিশ্বের ৪৯টি দেশ ও অঞ্চলে উইচ্যাট পে এর সেবা চালু রয়েছে। চীনের বাজারে ‘উইচ্যাট পে’ এর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আলিবাবা’র প্ল্যাটফর্ম ‘আলি পে’। উল্লেখ্য, ‘উইচ্যাট পে’ উইচ্যাটের একটি ফিচার হলেও ‘আলি পে’ একটি স্বতন্ত্র অ্যাপ।
তবে ‘আলি পে’ অ্যাপটিও সময়ের সাথে সাথে সুপার অ্যাপ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।
উইচ্যাট বিজনেস
চীনের বেশিরভাগ মানুষই ব্যবহার করে উইচ্যাট। ফলে দেশটিতে অনলাইনে ব্যবসা করা প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানেরই কোনো না কোনোভাবে উইচ্যাট এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। এর বাইরে মুদি দোকানীর মত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কর্পোরেট বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও ব্যবহার করে উইচ্যাট।
এছাড়া অন্যান্য দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানও চীনে ব্যবসা করছে। তাদেরও উইচ্যাটে যুক্ত থাকতে হয়।
এ সকল বিষয় বিবেচনা করে ব্যবসার কাজে উইচ্যাট ব্যবহার করা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ই-কমার্স নির্ভর নতুন এক ধরনের বিজনেস মডেল নিয়ে এসেছে উইচ্যাট। এবং এর নাম দেয়া হয়েছে ‘উইচ্যাট বিজনেস’। ই-কমার্স বিশ্বে আলিবাবা যেভাবে অনলাইনে পণ্য বিক্রির ব্যবসা পরিচালনা করে, তার তুলনায় উইচ্যাট বিজনেস বেশ আলাদাভাবে কাজ করে।
উইচ্যাট বিজনেস কাজ করে মূলত দুই ধরনের পদ্ধতিতে। এরমধ্যে একটি হল ‘বিটুসি মোড’, যাকে ‘বিজনেস টু কাস্টমার মোড’ও বলা হয়। এই পদ্ধতিতেই সবচেয়ে বেশি অর্থ লেনদেন হয় উইচ্যাটে।
হাসপাতাল, ব্যাংক, ফ্যাশন ব্র্যান্ড, ইন্টারনেট কোম্পানি কিংবা ব্যক্তিগত ব্লগিংয়ের মাধ্যমে যারা অর্থ উপার্জন করেন, তারা এই পদ্ধতিতে উইচ্যাট-এ নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
দ্বিতীয় পদ্ধতির নাম হল ‘বিটুবি মোড’, যাকে ‘বিজনেস টু বিজনেস মোড’ও বলা হয়। এ পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা নিজেদের পণ্য বিক্রি করে থাকেন। গ্রাহক ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে যোগাযোগের কাজও সম্পন্ন হয় এই পদ্ধতিতে।
তবে উইচ্যাট বিজনেস-এ নতুন নতুন ইউজার যুক্ত হওয়ার সঙ্গে বেশ কিছু সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। যেমন, উইচ্যাট বিজনেস এর মাধ্যমে চীনে নকল পণ্যের বিক্রি বাড়ছে। এর ফলে গ্রাহক পর্যায়ে অসন্তোষও তৈরি হয়েছে।
এদিকে বড় আকারের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ব্যবহারের জন্য ‘এন্টারপ্রাইজ উইচ্যাট’ নামে অ্যাপটির একটি ভার্শন মুক্তি পায় ২০১৬ সালে। মূলত কর্মীদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে কর্মজীবন আলাদা রাখতে সাহায্য করার জন্য অ্যাপটি বাজারে ছাড়া হয়েছিল।
কর্মীদের ছুটির দিন গণনা বা জমা-খরচ হিসাব করা কিংবা কর্মস্থলে কর্মীদের উপস্থিতি হিসাবে রাখার মত প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা কেন্দ্রিক বিভিন্ন ফিচার রয়েছে ‘এন্টারপ্রাইজ উইচ্যাট’-এ।
তথ্য নিরাপত্তা ও ব্যবহারের শর্তাবলী
চীনের নাগরিকদের উইচ্যাট ব্যবহারের জন্যে চীনা ফোন নম্বর ব্যবহার করে নিবন্ধন করতে হয়। চীনের নাগরিকদের এসব অ্যাকাউন্ট পরিচালিত হয় ‘ওয়েইসিন’ ব্র্যান্ডের অধীনে। এবং চীনা নাগরিকদের এসব ডেটা চীনের মূল ভূখণ্ডে সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়াও চীনের ইউজারদের উইচ্যাট ব্যবহারের জন্য তথ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত বেশ কিছু কঠোর শর্ত বা ‘টার্মস অফ সার্ভিস’ মেনে নিতে হয়। তুলনায় অন্য দেশের ব্যবহারকারীদেরকে এ ধরনের কঠোর শর্তাবলী মানার প্রয়োজন হয় না।
চীনের বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের নাগরিকদের মধ্যে যারা উইচ্যাট ইউজার, তাদের ডেটা সংরক্ষণ করা হয় নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত ডেটা সেন্টারে। এবং অন্যান্য দেশের ইউজারদের ডেটা সংরক্ষণ করা হয় সিঙ্গাপুরের ডেটা সেন্টারে।
দেশে দেশে সুপার অ্যাপ
এখনও পর্যন্ত উইচ্যাট এর মত শক্তিশালী সুপার অ্যাপ অন্য কেউ তৈরি করতে না পারলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুপার অ্যাপ তৈরি করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
বর্তমানে (২০২৩) এ ধরনের জনপ্রিয় একটি প্রচেষ্টার উদাহরণ ইলন মাস্ক, যিনি টুইটার অধিগ্রহণ করার পরে অ্যাপটিকে সুপার অ্যাপে পরিণত করার চেষ্টা করছেন। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তিনি টুইটার এর নামও পাল্টে ফেলেছেন। এদিকে মধ্য আমেরিকার প্রথম এবং সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল একটি সুপার অ্যাপের নাম হল ‘অমনি’ (Omni)। কোস্টারিকা ভিত্তিক এই অ্যাপটি উন্মুক্ত হয় ২০১৯ সালে। রাইড শেয়ারিং থেকে স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সুবিধা ও ফিচার রয়েছে এই অ্যাপে।
২০১৫ সালে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের দুজন উদ্যোক্তা যৌথভাবে তৈরি করেন ‘রেভোলুট’ (Revolut)। তবে অ্যাপটি মানি ট্রান্সফারের জন্যই সবচেয়ে পরিচিত। ভারতের এমন একটি সুপার অ্যাপ এর নাম ‘ফোনপে’ (PhonePe), যা দিয়ে খাবার অর্ডার বা ওষুধ কেনার মত অনেক কাজ করা যায়। ভারতের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান ‘টাটা গ্রুপ’ও তাদের সুপার অ্যাপ তৈরি করেছে, যার নাম ‘টাটা নিউ’ (Tata Neu)। বিমানের টিকিট কেনা, হোটেল বুকিং, অর্থ লেনদেন কিংবা অনলাইনে কেনাকাটা করা যায় এই অ্যাপ দিয়ে।
২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া ইন্দোনেশিয়ার একটি সফল সুপার অ্যাপের নাম ‘গোজেক’ (Gojek)। বর্তমানে অ্যাপটির ২০০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছে। এর বাইরে সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া ভিত্তিক অ্যাপ ‘গ্র্যাব’ (Grab) বেশ বিখ্যাত। আবার দক্ষিণ আমেরিকার অ্যাপ ‘রাপি’ (Rappi) এবং চীনের ‘আলি পে’ (Alipay) এর মত অনেক অ্যাপই নতুন নতুন ফিচার যুক্ত করার মাধ্যমে হয়ে উঠছে সুপার অ্যাপ।
উইচ্যাট এর ভবিষ্যৎ
বর্তমানে চীনে ব্যবহৃত ইন্টারনেট বা ডেটা ট্রাফিক এর ৩৪% আসে উইচ্যাট এর মাধ্যমে। ভবিষ্যতে এই পরিমাণ আরো বাড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এক জরিপ অনুসারে, ২০২৫ সালের মধ্যে ২৫৯ মিলিয়ন নতুন ইউজার যুক্ত হবেন উইচ্যাট এর সঙ্গে। একইসঙ্গে উইচ্যাট-এর ইউজারদের সংযুক্ত থাকার সময়ও বাড়বে।
বর্তমানে উইচ্যাট ইউজাররা গড়ে অ্যাপটির পেছনে ৭৭ মিনিট সময় ব্যয় করেন। ভবিষ্যতে নতুন নতুন ফিচার ও মিনি প্রোগ্রাম যুক্ত হতে থাকলে এই অ্যাপ দিয়ে করা সম্ভাব্য কাজের পরিমাণও বাড়বে। এতে ইউজাররা এই একটি অ্যাপের পেছনেই আরো বেশি সময় খরচ করবেন।
এছাড়াও উইচ্যাটের ই-কমার্স ভিত্তিক ‘মিনি প্রোগ্রাম’-এর ইউজারদের সিংহভাগই নারী। এক জরিপ অনুসারে, এই অ্যাপের ই-কমার্স ভিত্তিক সকল মিনি প্রোগ্রাম এর ৭১% ইউজারই নারী। অর্থাৎ, ভবিষ্যতের অর্থনীতিতে চীন ছাড়াও অন্যান্য দেশের নারীদের যুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এই সুপার অ্যাপ।
আবার, উইচ্যাটে প্রচারিত শর্ট ভিডিওর জনপ্রিয়তাও প্রচুর বাড়ছে। ২০২১-২২ সালের তুলনা করে দেখা গেছে, এক বছরে এই অ্যাপে প্রচারিত শর্ট ভিডিও দেখার পরিমাণ বেড়েছে ২৩৭%। অর্থাৎ, ইউটিউব রিলস বা টিকটক এর মত অ্যাপের সাথেও ভবিষ্যতে পাল্লা দিতে পারে উইচ্যাট।
এর বাইরে অ্যাপটিতে লাইভ স্ট্রিমিং এর জনপ্রিয়তাও প্রচুর পরিমাণ বাড়ছে। চীন এবং চীনের বাইরের অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরাই লাইভ স্ট্রিমিং এর মাধ্যমে নিজেদের পণ্য বিক্রি ও প্রচারের জন্য উইচ্যাটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন।
সবকিছু বিবেচনা করে বলাই যায়, ভবিষ্যতে চীনের বাইরেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের চিত্র পাল্টে দিতে পারে উইচ্যাট নামের অসাধারণ এই সুপার অ্যাপ।