দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে স্যামসাং এর প্রভাব অনেক বেশি। এতটাই বেশি যে, অন্য কোনো দেশের অর্থনীতির সঙ্গে এভাবে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনাই করা যায় না। ২০২২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ২২.৪ শতাংশ এসেছে শুধুমাত্র স্যামসাং এর ব্যবসা থেকে। সে বছর প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছে মোট ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ একটি প্রতিষ্ঠান হল স্যামসাং। এ বছর (২০২৩) ‘ফরচুন ফাইভ হান্ড্রেড’ এর তালিকায় বিশ্বের বৃহত্তম ৫০০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৫ নম্বরে স্থান পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রসিদ্ধ এই তালিকাটি তৈরি করে আমেরিকান বিজনেস ম্যাগাজিন ‘ফরচুন’।
তবে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করেছে যার উদ্যোগে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত। অন্তত অ্যাপল, মাইক্রোসফট বা গুগল এর মত কোম্পানির তুলনায় স্যামসাং এর প্রতিষ্ঠাতার ব্যাপারে জানে অনেক কম মানুষ। অবশ্য এসব কোম্পানির তুলনায় স্যামসাং এর ইতিহাসও অনেক পুরোনো। আজ থেকে ৮৫ বছর আগে ১৯৩৮ সালে স্যামসাং প্রতিষ্ঠা করেন লি বিয়ং চল (Lee Byung Chull)।
আরও পড়ুনঃ স্যামসাং মোবাইলের দাম বাংলাদেশ ২০২৩
শুরুতে প্রযুক্তি নিয়ে ব্যবসা না করলেও সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয় লি বিয়ং চল এর হাতে গড়ে ওঠা স্যামসাং। স্যামসাং এর দীর্ঘ এই ইতিহাসের অনেকটাই লিখেছেন এর প্রতিষ্ঠাতা লি বিয়ং চল নিজে। তার গ্রহণ করা অনেক সিদ্ধান্তের যোগফলই হল আজকের বিখ্যাত কোম্পানি স্যামসাং।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
১৯১১ সালে কোরিয়ার উইরইয়ং কাউন্টিতে জন্মগ্রহণ করেন লি বিয়ং চল। তার জন্মের আগের বছরই (১৯১০) সমগ্র কোরিয়া নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় জাপান।
চার ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন লি বিয়ং চল। তাদের পরিবার ছিল ‘ইয়াংবান’ নামের বেশ ধনী ও ক্ষমতাশালী এক সামাজিক শ্রেণীর অংশ। সে সময়কার সম্ভ্রান্ত এই শ্রেণীর মানুষেরা সাধারণত উচ্চশিক্ষিত হত। এবং এই শ্রেণীর মধ্য থেকেই নিয়োগ দেয়া হত রাষ্ট্রের বেসামরিক কর্মচারী ও সামরিক কর্মকর্তাদের ।
প্রাথমিক শিক্ষার জন্য লি বিয়ং চল ভর্তি হন বর্তমান দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল-এ অবস্থিত ‘জুংডং হাই স্কুল’-এ। জুংডং এর ২৬ তম ব্যাচ এর ছাত্র ছিলেন লি বিয়ং চল। এরপর তিনি জাপানের ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য ভর্তি হন। তবে সেখান থেকে স্নাতক শেষ না করেই নিজ দেশে ফিরে আসেন।
স্যামসাং প্রতিষ্ঠা
১৯৩৮ সালে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বর্তমান দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় জনবহুল শহর বুসান-এ পাড়ি জমান লি বিয়ং চল। তখন তার বয়স ২৯ এবং হাতে ছিল অল্প কিছু অর্থ, বর্তমান সময়ের হিসেবে যার পরিমাণ মাত্র ৩০ ডলার।
সে বছরের পহেলা মার্চ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘স্যামসাং’। কোরিয়ান ভাষায় ‘স্যাম’ অর্থ তিন (৩) এবং ‘সাং’ অর্থ তারকা। তিন সংখ্যাটি, পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মত কোরিয়াতেও জনপ্রিয় ছিল বিভিন্ন কারণে। এবং প্রতীক হিসেবে তারকার ধারণাও ছিল বেশ প্রচলিত।
স্যামসাং প্রতিষ্ঠার পর কোম্পানির লোগোতেও তিনটি তারকা রাখা হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে এই লোগোতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আনা হলেও ১৯৯৩ সালের আগ পর্যন্ত স্যামসাং এর সকল লোগোতে তিনটি তারকার চিহ্ন দেখা যেত।
শুরুর কয়েক বছর স্যামসাং এর মাধ্যমে শুধুমাত্র পণ্য পরিবহনের ব্যবসা করেছেন লি বিয়ং চল। এই চিত্র পাল্টে যায় ১৯৪৫ সালে। সে বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে আসে এবং জাপানী সাম্রাজ্য ও শাসনের কবল থেকে মুক্তি পায় কোরিয়া। ততদিনে কোরিয়ার বাইরেও পণ্য পরিবহনের ব্যবসা শুরু করে স্যামসাং।
১৯৪৭ সালের মধ্যে বুসান থেকে স্যামসাং এর সদর দপ্তর বর্তমান দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল-এ স্থানান্তর করেন লি বিয়ং চল। স্বাধীনতার পরের সময়টাতে বিশ্বের অন্যতম গরিব দেশ ছিল কোরিয়া। তবে এ কারণে দেশটিতে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদাও ছিল অনেক বেশি। বিভিন্ন ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা মেটানোর মাধ্যমে যেসব কোম্পানি কোরিয়ায় ব্যবসা করছিল, তার মধ্যে স্যামসাং ছিল অন্যতম।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মাথায় শুরু হয় ‘কোরীয় যুদ্ধ’ বা ‘কোরিয়ান ওয়ার’। যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে ছিল জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা অন্যান্য দেশ। এবং উত্তর কোরিয়ার পক্ষে ছিল চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বলকান অঞ্চলের কিছু দেশ।
কুখ্যাত সেই যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে আজও উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া দুই ভাগে বিভক্ত। ১৯৫০ সালে কোরীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় দেশটির শীর্ষ ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ছিল স্যামসাং। তবে যুদ্ধের এক পর্যায়ে সিউল অধিগ্রহণ করে নেয় উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী। এতে স্যামসাং এর বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।
ফলে নিজের ব্যবসা আবারো বুসানে সরিয়ে আনতে বাধ্য হন লি বিয়ং চল। কিন্তু এতে বেশ লাভও হয় তার। কারণ যুদ্ধের সময় বুসানে ব্যাপকভাবে মার্কিন সৈন্য ও সরঞ্জাম আসা শুরু হয়। এবং এতে তৃতীয় পক্ষের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেশ মোটা অঙ্কের লাভ করেন লি বিয়ং চল। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ই ১৯৫১ সালে কর্পোরেশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে স্যামসাং এবং এক বছরের মধ্যেই তারা কোরিয়ান মুদ্রায় ২ বিলিয়ন ওয়ান (Won) আয় করে।
কোরিয়ার অর্থনীতি বিনির্মাণে স্যামসাং এর ভূমিকা
১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্যই তখন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত। আমদানির ওপর দেশটির নির্ভরযোগ্যতা কমাতে স্যামসাং সহ দেশটির আরো কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের দেশে পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়।
এরই অংশ হিসেবে ১৯৫৩ সালে চিনিকল এবং ১৯৫৪ সালে পশমি কাপড় তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করে স্যামসাং। সময়ের সাথে সাথে কোরিয়ার চিনি ও পশমি কাপড়ের বাজারে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ নাম হয়ে ওঠে স্যামসাং ব্র্যান্ড।
শিল্প-কারখানায় পণ্য উৎপাদনে সফলতার হাত ধরে স্যামসাং একটা সময় দেশটির আর্থিক খাতেও ব্যবসা শুরু করে। ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ এবং অধিগ্রহণের মাধ্যমে আকারে বড় হতে থাকে স্যামসাং। ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে এসে স্যামসাং হয়ে ওঠে কোরিয়ার সবচেয়ে বড় কর্পোরেশন।
কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও নতুন ধরনের পদ্ধতি চালু করে প্রতিষ্ঠানটি। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা শিক্ষার্থীদেরকে নিয়োগ দেয়া শুরু করে তারা। এতে দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজের দেশেই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।
১৯৬১ সালে সামরিক শাসন শুরু হয় দেশটিতে। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে লি বিয়ং চল এবং তার প্রতিষ্ঠান স্যামসাং যতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাতে ভাটা পড়ে। কোরিয়ার অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অনেকটাই সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে হয় তাকে।
এ সময় চাষাবাদের জন্যে সার কারখানা নির্মাণ ও কাগজ তৈরির শিল্পে ব্যবসা শুরু করে স্যামসাং। একই সঙ্গে রপ্তানি শিল্পে অনেকটাই এগিয়ে যায় তারা। কোরিয়ার মোট রপ্তানির বড় একটা অংশই স্যামসাং এর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। দেশের ভেতরেও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, সংবাদপত্র, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং সার্ভিস বা সেবা নির্ভর অনেক শিল্পে ব্যবসা শুরু করে স্যামসাং।
প্রযুক্তি শিল্পে স্যামসাং
প্রযুক্তি বিশ্বে তখনো কোরিয়ান কোনো প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি ছিল না। লি বিয়ং চল এর উদ্যোগে এই চিত্রে পরিবর্তন আনা শুরু করে স্যামসাং।
১৯৬৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর লি বিয়ং চল সহ স্যামসাং এর সবচেয়ে বড় ৭ জন শেয়ারহোল্ডার একটি মিটিং-এ যোগ দেন। প্রযুক্তি শিল্পে ব্যবসা শুরু করার জন্য স্যামসাং এর অধীনে পরিচালিত নতুন প্রতিষ্ঠানের নাম ও প্রাথমিক কার্যপদ্ধতি ঠিক করাই ছিল সেই মিটিং এর উদ্দেশ্য।
নতুন প্রতিষ্ঠানের নাম হিসেবে ‘চেইল ইলেকট্রনিকস’, ‘স্যামসাং ইলেকট্রনিকস’, এবং ‘স্যামসাং ইলেকট্রিক’ এর মত বেশ কিছু নাম প্রস্তাব করা হয়। ভোটের মাধ্যমে অবশেষে ‘স্যামসাং ইলেকট্রনিকস’ নামটিই নির্ধারণ করা হয়। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘স্যামসাং ইলেকট্রনিকস কোম্পানি লিমিটেড’। সে সময় অন্যান্য যেসব দেশ প্রযুক্তি পণ্য নির্মাণ ও গবেষণায় এগিয়ে ছিল, তাদের তুলনায় প্রায় অর্ধ শতাব্দী পিছিয়ে ছিল স্যামসাং।
কিন্তু মূলধনের অভাব না থাকায় এবং মেধাবী কর্মশক্তির সাহায্যে এই শূন্যস্থান অল্প সময়ের মধ্যেই পূরণ করতে সক্ষম হয় প্রতিষ্ঠানটি। ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাণের জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ দক্ষিণ কোরিয়াতে তৈরি করাটা ছিল স্যামসাং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
১৯৭১ সালের মধ্যে ‘স্যামসাং ইলেক্ট্রিকস কোম্পানি লিমিটেড’ নামের আরেকটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন লি বিয়ং চল, যার উদ্দেশ্য নতুন প্রোডাক্ট উদ্ভাবন করা। অন্যদিকে ‘স্যামসাং ইলেকট্রনিকস কোম্পানি লিমিটেড’ শুধুমাত্র পণ্য নির্মাণের কাজই করত।
১৯৭২ সালের মধ্যে একটি ক্যালকুলেটর ফ্যাক্টরি এবং একটি টেলিভিশন ফ্যাক্টরির কার্যক্রম শুরু করে স্যামসাং। পরবর্তীতে অন্যান্য প্রোডাক্ট তৈরি করার জন্য কোরিয়া জুড়ে ফ্যাক্টরি নির্মাণ করতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
স্যামসাং এর নিজস্ব মডেলের প্রথম টেলিভিশন ছিল ‘মাহা ৫০৬’। এদিকে ১৯৭৫ সালে স্যামসাং তাদের প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল প্রোডাক্ট বাজারে আনে। ‘ইকোনো টিভি’ নামের এই টেলিভিশন বাজারে আসার সাথে সাথে জনপ্রিয় হয়। সে বছরের (১৯৭৫) ডিসেম্বরের মধ্যে এই মডেলের ৩৪ হাজার টেলিভিশন সেট বিক্রি করে তারা।
১৯৭৮ সালে একই মডেলের প্রায় সাড়ে সাত লাখ টেলিভিশন সেট বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। এই টিভি সেট এর জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল, সে সময়কার অন্যান্য টেলিভিশনের তুলনায় এতে বিদ্যুৎ খরচ হত কম। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ায় তাদের ‘হাই কোল্ড’ মডেলের রেফ্রিজারেটরও জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৭৮ সালের মধ্যেই কোরিয়ার সর্বাধিক বিক্রিত রেফ্রিজারেটর হিসেবে শীর্ষে উঠে আসে হাই কোল্ড।
কোরিয়ায় প্রথম রঙিন টেলিভিশনও তৈরি শুরু করে স্যামসাং। এছাড়াও ক্যাসেটের আগে জনপ্রিয় ‘এইট-ট্র্যাক টেপ’ নামের ম্যাগনেটিক-টেপ সাউন্ড রেকর্ডিং যন্ত্র উৎপাদন শুরু করে তারা। বাজারে আনে কোরিয়ার প্রথম ‘ফ্রস্ট-ফ্রি রেফ্রিজারেটর’, যাতে সহজে বরফ জমত না।
প্রযুক্তি ক্ষেত্রে স্যামসাং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল নিজেদের কারখানায় সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণ শুরু করা। এতে করে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি পণ্য খুব কম খরচেই নির্মাণ করতে সক্ষম হয় প্রতিষ্ঠানটি। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র তখন সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণ শিল্পে অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই স্যামসাং এর মাধ্যমে এ দুটি দেশের সমপর্যায়ে চলে আসে দক্ষিণ কোরিয়া।
স্যামসাং এর তৈরি রেকর্ড ক্যাসেট এবং এএম/এফএম রেডিও-ক্যাসেট এর মত যন্ত্র কোরিয়া ছাড়াও আমেরিকার বাজারে জনপ্রিয়তা পায়। এছাড়াও তারা ওয়াশিং মেশিন, ফ্যান, বৈদ্যুতিক চুলা, বৈদ্যুতিক রাইস কুকার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ভিসিআর কিংবা ইলেক্ট্রিক ডেস্ক ক্যালকুলেটর এর মত কনজিউমার ইলেক্ট্রনিকস এর বাজারে নানান ধরনের প্রোডাক্ট আনতে থাকে।
১৯৭৯ সালে ১০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে স্যামসাং, যার মধ্যে অধিকাংশ প্রোডাক্টই ছিল কনজিউমার ইলেক্ট্রনিকস। খুব দ্রুতই দক্ষিণ কোরিয়ার মোট রপ্তানি করা পণ্যের তালিকায় স্যামসাং এর ইলেক্ট্রনিকস পণ্য একটা বড় জায়গা দখল করে নেয়। এবং এর মাধ্যমেই ইলেক্ট্রনিকস পণ্য রপ্তানিতে অন্যতম শীর্ষ দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া প্রতিষ্ঠা পায়।
১৯৮৬ সালে প্রথম মেগাবাইট ক্ষমতার সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করে স্যামসাং। ‘১ মেগাবাইট ডি-র্যাম’ নামের সেই সেমিকন্ডাক্টর তৈরির মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি পায় দক্ষিণ কোরিয়া।
পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময় স্যামসাং এর ইলেকট্রনিক অ্যাপ্লায়েন্স ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে স্যামসাং তাদের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্যের কারণে বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত, যার মধ্যে টেলিভিশন, ফ্রিজ, এসি এবং মাইক্রোওয়েভ ওভেন অন্যতম।
তবে স্যামসাং এর সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্য হল স্মার্টফোন এবং তাদের স্মার্টফোনই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। শুধুমাত্র ২০২২ সালেই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৬০ মিলিয়ন স্মার্টফোন বিক্রি করেছে। বিশ্বজুড়ে যত স্মার্টফোন বিক্রি হয়, তার মধ্যে ২০ শতাংশই স্যামসাং এর। ১৭ শতাংশ বাজার দখল করে স্যামসাং এর পরে রয়েছে অ্যাপল এর অবস্থান।
দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যান্য শিল্পে স্যামসাং
৭০ এবং ৮০’র দশক জুড়ে নতুন নতুন আরো অনেক শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবসা শুরু করে স্যামসাং। ভারি শিল্প, জাহাজ নির্মাণ, পেট্রোকেমিক্যাল, নির্মাণ শিল্প, রাসায়নিক, বিমান পরিবহন, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান, থিম পার্ক, অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি কিংবা হোটেলের মত বিভিন্ন শিল্পে ব্যবসা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
বিভিন্ন শিল্পজুড়ে পরিচালিত স্যামসাং-এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের ট্রেনিং দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় আলাদা ট্রেনিং সেন্টার। নতুন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্যে গড়ে তোলা হয় ‘স্যামসাং ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’।
স্যামসাং এসকল উদ্যোগ সম্ভব হয়েছিল লি বিয়ং চল এর সিদ্ধান্তে। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখায় ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
লি বিয়ং চল এর মৃত্যু ও স্যামসাং এর অগ্রযাত্রা
১৯৮৭ সালের ১৯ নভেম্বর মারা যান লি বিয়ং চল। জীবিত অবস্থায় তিনি বেশ কয়েকবার দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে ধনী মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এছাড়া মিডিয়ার সামনে তিনি খুব একটা আসতেন না।
তার প্রতিষ্ঠিত স্যামসাং-এ বর্তমানে ৭৪টি দেশের ২,৬৬,০০০ কর্মী কাজ করে। ব্র্যান্ড ভ্যালুর হিসাবে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মূল্যবান ব্র্যান্ড হল স্যামসাং। এবং ২০২২ সালের এক জরিপ অনুসারে গুগলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে মূল্যবান ব্র্যান্ড এর খেতাব অর্জন করেছিল স্যামসাং।
লি বিয়ং চল তার মৃত্যুর আগে শৈশবের বিদ্যালয় জুংডং হাই স্কুল এর উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠানটি স্যামসাং এর অধিগ্রহণে আনার নির্দেশনা দিয়ে যান। ১৯৯৪ সালে তার উইল অনুসারে বিদ্যালয়টি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে স্যামসাং। বর্তমানে জুংডং হাই স্কুল থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের কোরিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি।
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে স্যামসাং গ্রুপের কর্ণধারের অবদানের কথা সে দেশের প্রায় সবাই জানে। তবে বেশ কিছু সমালোচনাও আছে তার নামে। বিশেষ করে স্যামসাং সহ দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যান্য কর্পোরেশন যে দেশটির অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে, সে ব্যাপারটা তখন এবং এখনও অনেকে সমালোচনার চোখে দেখেন।
তবে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের অসাধারণ গল্পে লি বিয়ং চল এর বিপুল পরিমাণ অবদানের কথা স্বীকার করে থাকেন সমালোচকরাও।