অনলাইন ব্যবসা এবং ওয়েবসাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন) একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ওয়েবসাইটকে সার্চ ইঞ্জিনের প্রথম পেজে আনতে পারি। এসইও মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত: অন-পেজ এসইও এবং অফ-পেজ এসইও। আজকের আলোচনায় আমরা অন-পেজ এসইও (On-Page SEO) নিয়ে বিস্তারিত জানবো এবং কিভাবে ২০২৪ সালে অন-পেজ এসইও করবেন, তা নিয়ে আলোচনা করবো।
অন পেজ এসইও কি?
অন-পেজ এসইও হল সেই সমস্ত কৌশল যা ওয়েবসাইটের মধ্যেই করা হয় যাতে সার্চ ইঞ্জিনগুলি ওয়েবসাইটের বিষয়বস্তু (Contents) সহজে বুঝতে পারে এবং প্রাসঙ্গিকতার (Relevancy) ভিত্তিতে র্যাংকিং প্রদান করতে পারে। এর মধ্যে থাকে কনটেন্ট অপ্টিমাইজেশন, কীওয়ার্ড ব্যবহার, মেটা ট্যাগস, ইমেজ অপ্টিমাইজেশন, এবং ইউআরএল স্ট্রাকচার ইত্যাদি।
কিভাবে অন পেজ এসইও করবেন (সঠিক নিয়ম)
২০২৪ সালে অন-পেজ এসইও করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ অনুসরণ করতে হবে:
১. কীওয়ার্ড রিসার্চ
কীওয়ার্ড রিসার্চ হল এসইওর মূল ভিত্তি। সঠিক কীওয়ার্ড নির্বাচন করলে আপনার কনটেন্ট সার্চ ইঞ্জিনে সহজেই পাওয়া যাবে। বিভিন্ন টুল ব্যবহার করে কীওয়ার্ড রিসার্চ করতে পারেন, যেমন Google Keyword Planner, Ahrefs, SEMrush ইত্যাদি। এসব টুলের মাধ্যমে আপনি কীওয়ার্ডের সার্চ ভলিউম, প্রতিযোগিতা, এবং ট্রেন্ড সম্পর্কে তথ্য পেতে পারেন।
কীওয়ার্ড রিসার্চ করার সময় মূল কীওয়ার্ডের পাশাপাশি LSI (Latent Semantic Indexing) কীওয়ার্ডগুলিও বিবেচনা করতে হবে। LSI কীওয়ার্ড হল সেই কীওয়ার্ডগুলি যা মূল কীওয়ার্ডের সাথে সম্পর্কিত (Related Keyword) এবং কনটেন্টকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার মূল কীওয়ার্ড হয় “অন-পেজ এসইও,” তাহলে LSI কীওয়ার্ড হতে পারে “এসইও কৌশল,” “ওয়েবসাইট অপ্টিমাইজেশন,” বা “কীওয়ার্ড ব্যবহার।” এইভাবে, কীওয়ার্ড রিসার্চের মাধ্যমে আপনি একটি শক্তিশালী এসইও কৌশল তৈরি করতে পারবেন যা আপনার ওয়েবসাইটের ট্রাফিক এবং র্যাংকিং বৃদ্ধি করবে।
২. টাইটেল ট্যাগ অপ্টিমাইজেশন
প্রতিটি পেজের জন্য ইউনিক এবং আকর্ষণীয় টাইটেল ট্যাগ তৈরি করুন। টাইটেল ট্যাগে আপনার মূল কীওয়ার্ডটি অন্তর্ভুক্ত করুন যাতে সার্চ ইঞ্জিন সহজেই বুঝতে পারে পৃষ্ঠাটি কী বিষয়ে।
টাইটেল ট্যাগ অপ্টিমাইজেশনের জন্য কিছু মূল কৌশল রয়েছে। প্রথমত, প্রতিটি পৃষ্ঠার জন্য ইউনিক এবং সংক্ষিপ্ত টাইটেল তৈরি করুন, যা মূল কীওয়ার্ড অন্তর্ভুক্ত করে। একটি টাইটেল সাধারণত ৫০-৬০ ক্যারেক্টারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত, যাতে এটি পুরোপুরি সার্চ ইঞ্জিন রেজাল্ট পেজে প্রদর্শিত হয়। দ্বিতীয়ত, টাইটেলের শুরুতে মূল কীওয়ার্ড ব্যবহার করুন, কারণ এটি সার্চ ইঞ্জিনে অধিক গুরুত্ব পায়। এছাড়া, আকর্ষণীয় এবং তথ্যবহুল টাইটেল তৈরি করুন যা ব্যবহারকারীদের ক্লিক করতে উদ্বুদ্ধ করবে। উদাহরণস্বরূপ, “২০২৪ সালে কিভাবে অন-পেজ এসইও করবেন: সেরা কৌশল এবং টিপস” এর মতো টাইটেলগুলি ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করবে এবং তাদের আপনার ওয়েবসাইটে নিয়ে আসবে।
৩. মেটা ডিসক্রিপশন
মেটা ডিসক্রিপশন হল সেই ছোট বিবরণ যা সার্চ ইঞ্জিন রেজাল্ট পেজে (SERP) প্রদর্শিত হয়। এটি আপনার ওয়েবসাইটের ক্লিক থ্রু রেট (CTR) বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। মেটা ডিসক্রিপশনে আপনার মূল কীওয়ার্ড এবং একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ ব্যবহার করুন যা ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ করবে।
৪. হেডিং ট্যাগস (H1, H2, H3)
হেডিং ট্যাগগুলি ওয়েবসাইটের কনটেন্টকে ভালভাবে স্ট্রাকচার করতে সাহায্য করে। H1 ট্যাগে আপনার মূল কীওয়ার্ড অন্তর্ভুক্ত করুন এবং অন্যান্য হেডিং ট্যাগে রিলেটেড কীওয়ার্ড ব্যবহার করুন। এটি ব্যবহারকারীদের পড়তে সহজ করে এবং সার্চ ইঞ্জিনগুলি সহজেই বিষয়বস্তু বুঝতে পারে।
৫. কনটেন্ট অপ্টিমাইজেশন
আপনার ওয়েবসাইটের কনটেন্ট অবশ্যই হাই কোয়ালিটি এবং ব্যবহারকারীদের জন্য প্রাসঙ্গিক হতে হবে। প্রাসঙ্গিকতা (Relevancy) বজায় রাখতে আপনার মূল কীওয়ার্ড এবং LSI (Latent Semantic Indexing) কীওয়ার্ডগুলি কৌশলগতভাবে কনটেন্টে অন্তর্ভুক্ত করুন। কনটেন্ট লেখার সময় নিশ্চিত করুন যে এটি তথ্যবহুল এবং ব্যবহারকারীদের জন্য মূল্যবান। পাশাপাশি, কনটেন্টে পর্যাপ্ত সাব টাইটেল, বুলেট পয়েন্ট, এবং নম্বরযুক্ত তালিকা ব্যবহার করুন যাতে এটি পড়তে সহজ হয়।
এছাড়াও, আপনার কনটেন্টে ইন্টারনাল এবং এক্সটারনাল লিঙ্কগুলি অন্তর্ভুক্ত করুন। ইন্টারনাল লিঙ্কিং আপনার ওয়েবসাইটের বিভিন্ন পৃষ্ঠাগুলির মধ্যে নেভিগেশন সহজ করে এবং সার্চ ইঞ্জিনগুলিকে আপনার সাইটের স্ট্রাকচার বোঝাতে সহায়তা করে। এক্সটারনাল লিঙ্কিং উচ্চমানের ওয়েবসাইটগুলির সাথে আপনার কনটেন্টের প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি করে। নিয়মিত কনটেন্ট আপডেট করা, নতুন তথ্য যোগ করা এবং পুরনো তথ্য সংশোধন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যাতে আপনার কনটেন্ট সর্বদা আপ-টু-ডেট থাকে।
আরও দেখুনঃ এসইও ফ্রেন্ডলি আর্টিকেল লেখার নিয়ম – কনটেন্ট রাইটিং টিপস
৬. ইমেজ অপ্টিমাইজেশন
ওয়েবসাইটে ব্যবহৃত ইমেজগুলির ফাইল নাম এবং ALT ট্যাগে কীওয়ার্ড ব্যবহার করুন। ইমেজ ফাইল সাইজ কম রাখার চেষ্টা করুন যাতে পেজ লোড টাইম কম হয়। ইমেজ অপ্টিমাইজেশন সার্চ ইঞ্জিনের ইমেজ সার্চেও সাহায্য করে।
৭. ইউআরএল স্ট্রাকচার
ইউআরএল স্ট্রাকচার পরিষ্কার এবং সংক্ষিপ্ত রাখুন। ইউআরএলে কীওয়ার্ড ব্যবহার করুন এবং বিশেষ ক্যারেক্টার এড়িয়ে চলুন। এটি ব্যবহারকারীদের এবং সার্চ ইঞ্জিন উভয়ের জন্যই সুবিধাজনক।
৮. মোবাইল ফ্রেন্ডলি ডিজাইন
মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তাই আপনার ওয়েবসাইট মোবাইল ফ্রেন্ডলি হতে হবে। একটি রেস্পন্সিভ ডিজাইন ব্যবহার করুন যা মোবাইল এবং ডেস্কটপ উভয় ডিভাইসে ভালভাবে প্রদর্শিত হয়। বর্তমানে যেসব ওয়ার্ডপ্রেস থিম, ব্লগার টেম্পলেট রয়েছে সেগুলো সবই মোবাইল ফ্রেন্ডলি কথা মাথায় রেখে তৈরি।
৯. পেজ স্পিড অপ্টিমাইজেশন
ওয়েবসাইটের পেজ লোড টাইম কম রাখুন। পেজ স্পিড অপ্টিমাইজেশন করতে বিভিন্ন টুল ব্যবহার করতে পারেন, যেমন Google PageSpeed Insights, GTmetrix ইত্যাদি। দ্রুত লোডিং ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে এবং সার্চ ইঞ্জিন র্যাংকিং উন্নত করে।
যদিও এটা টেকনিক্যাল কাজ, তবে আপনি ওয়ার্ডপ্রেস ইউজার হলে বিভিন্ন প্লাগিন ইউজ করে সহজেই কাজটি করতে পারবেন। পেজ স্পিড ভালো রাখার জন্য লাইট থিম ব্যবহার করুন। টেকনিক্যাল জ্ঞান থাকলে অদরকারি JS, CSS, HTML ফাইলগুলো ডিলিট করে দিন আপনার থিম থেকে। অদরকারি উইজেট/সেকশন ওয়েবপেইজে না রাখাই ভালো। আপনার ওয়েবসাইট যদি বাংলাদেশী ভিজিটর টার্গেট করা হয় তাহলে আপনি ভালো মানের Bdix হোস্টিং ইউজ করতে পারেন।
১০. স্কিমা মার্কআপ
স্কিমা মার্কআপ হল একটি কোড যা সার্চ ইঞ্জিনকে আপনার ওয়েবসাইটের তথ্য আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করে। এটি রিচ স্নিপেট প্রদর্শনের মাধ্যমে আপনার ক্লিক থ্রু রেট বৃদ্ধি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রেসিপি, রিভিউ, ইভেন্ট, প্রোডাক্ট ইত্যাদির জন্য স্কিমা মার্কআপ ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ফলে সার্চ ইঞ্জিন রেজাল্ট পেজে (SERP) আপনার ওয়েবসাইটের প্রদর্শন আকর্ষণীয় হয় এবং ক্লিক থ্রু রেট (CTR) বৃদ্ধি পায়।
স্কিমা মার্কআপ করার জন্য প্রথমে আপনাকে স্কিমা.org ওয়েবসাইট থেকে আপনার প্রয়োজনীয় স্কিমা কোড সংগ্রহ করতে হবে। এটি আপনার ওয়েবপৃষ্ঠার HTML কোডে যুক্ত করতে হবে। বিভিন্ন ধরণের স্কিমা আছে, যেমন Article, BlogPosting, LocalBusiness, Product ইত্যাদি। প্রতিটি স্কিমার নিজস্ব কোড ফরম্যাট থাকে। স্কিমা মার্কআপ যোগ করার পর, Google এর Structured Data Testing Tool ব্যবহার করে এটি ঠিকমত কাজ করছে কিনা পরীক্ষা করতে পারেন।
র্যাঙ্কিং এর ক্ষেত্রে On Page SEO এর গুরুত্ব
অন-পেজ এসইও একটি ওয়েবসাইটের সাথে সার্চ ইঞ্জিনের যোগাযোগ স্থাপনের প্রধান মাধ্যম। যখন আপনি সঠিকভাবে অন-পেজ এসইও করেন, তখন সার্চ ইঞ্জিনগুলি সহজে আপনার ওয়েবসাইটের নিশ (Niche) বুঝতে পারে। এর ফলে, তারা আপনার ওয়েবসাইটকে প্রাসঙ্গিক সার্চ কুয়ারির জন্য র্যাংকিংয়ে অগ্রাধিকার দেয়। সঠিক টাইটেল ট্যাগ, মেটা ডিসক্রিপশন, এবং হেডিং ট্যাগের মাধ্যমে সার্চ ইঞ্জিনগুলি আপনার ওয়েবসাইটের মূল বিষয় এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পায়।
অন-পেজ এসইও শুধুমাত্র সার্চ ইঞ্জিনের জন্য নয়, বরং ব্যবহারকারীদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। একটি ওয়েল-অপ্টিমাইজড ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীদের জন্য সহজে নেভিগেটেবল এবং পাঠযোগ্য হয়। দ্রুত লোডিং টাইম, রেস্পন্সিভ ডিজাইন, এবং উপযুক্ত কনটেন্ট ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে। ব্যবহারকারীরা যখন আপনার ওয়েবসাইটে ভাল অভিজ্ঞতা পান, তখন তারা আরও সময় ব্যয় করে এবং পুনরায় ওয়েবসাইটে ফিরে আসে, যা সার্চ ইঞ্জিনের চোখে আপনার ওয়েবসাইটের মূল্য বাড়িয়ে তোলে।
আরও দেখুনঃ বাংলাদেশে ব্যবসার জন্য SEO কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বর্তমান ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে প্রতিযোগিতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি সঠিকভাবে অপ্টিমাইজড ওয়েবসাইট প্রতিযোগিতার মধ্যে আপনার ওয়েবসাইটকে আলাদা করে তুলতে পারে। সার্চ ইঞ্জিনের প্রথম পৃষ্ঠায় থাকা মানেই আপনার ব্র্যান্ড বা ব্যবসার জন্য বেশি দৃশ্যমানতা (Brand Presence) এবং ট্রাফিক। অন-পেজ এসইও কৌশলগুলি প্রয়োগ করে আপনি প্রতিযোগীদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে পারেন এবং সম্ভাব্য গ্রাহকদের আপনার ওয়েবসাইটে আকৃষ্ট করতে পারেন।
পাথক্যঃ অন-পেজ এসইও, অফ-পেজ এসইও এবং টেকনিক্যাল এসইও
নিচে অন-পেজ এসইও, অফ-পেজ এসইও, এবং টেকনিক্যাল এসইও-এর মধ্যে পার্থক্য একটি টেবিলের আকারে প্রদান করা হল:
এসইও ধরণ | বিবরণ | উদাহরণ |
---|---|---|
অন-পেজ | ওয়েবসাইটের অভ্যন্তরীণ অপ্টিমাইজ করা যাতে সার্চ ইঞ্জিনে র্যাংকিং উন্নত হয়। | টাইটেল ট্যাগ, মেটা ডিসক্রিপশন, কনটেন্ট অপ্টিমাইজেশন, ইমেজ অপ্টিমাইজেশন, হেডিং ট্যাগস |
অফ-পেজ | ওয়েবসাইটের বাইরের কার্যকলাপ যা সার্চ ইঞ্জিন র্যাংকিং প্রভাবিত করে। | ব্যাকলিঙ্কিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, গেস্ট ব্লগিং, প্রেশ রিলিজ |
টেকনিক্যাল | ওয়েবসাইটের প্রযুক্তিগত দিক যা সার্চ ইঞ্জিন বটগুলির জন্য সাইটের ক্রোলিং এবং ইনডেক্সিং উন্নত করে। | সাইটম্যাপ তৈরি, SSL সার্টিফিকেট, পেজ স্পিড অপ্টিমাইজেশন, মোবাইল ফ্রেন্ডলি ডিজাইন |
উপসংহার
অন-পেজ এসইও হল একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশনের মাধ্যমে আপনার ওয়েবসাইটের দৃশ্যমানতা এবং র্যাংকিং উন্নত করতে সাহায্য করে। সঠিক কৌশল এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে আপনি ২০২৪ সালে আপনার ওয়েবসাইটকে সার্চ ইঞ্জিনের প্রথম পেজে আনতে সক্ষম হবেন। আশা করি এই নির্দেশিকা আপনাকে আপনার অন-পেজ এসইও কৌশল উন্নত করতে সাহায্য করবে।